top of page

Protishodh

Noted Nest

Updated: Oct 1, 2024

By Sanchita Kar



ডহলদীঘি গ্রামে সব স্কুলে গরমের ছুটি পরার জন্য বাচ্চারা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে কারণ সেই সময় প্রতি বছর মোড়ল মশাই বড় করে মেলার আয়োজন করেন। সমস্ত বাচ্চারা রোজ বিকেল হলেই বাবা, মা, ভাই, বোনদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসে মেলা দেখতে। এমনকি অনেকে নিজেদের দুরের আত্মীয় স্বজনদেরও ডেকে নেয় মেলা দেখাবে বলে। কত রকমের যে দোকান; খাবার, খেলনা, জামা কাপর, নাগরদোলা, বাসন-কোসন কিছুই বাদ থাকে না। এই সময় বাইরে থেকেও কিছু কারিগরেরা আসে কখনো কখনো। বিশাল মাঠ জুড়ে পুরো জমজমাট পরিবেশ তৈরি হয় একটা, হইহুল্লোরে ভরে যায় চারিদিক।

সেই সেবার  যখন গৃষ্য কালের মেলা বসল,  এক নতুন আকর্ষণ নিয়ে হাজির হলো এক অবাঙালি ভদ্রলোক। পুতুল নাচের ঠেলা দোকান তার। কি সুন্দর সব রঙিন পুতুল, দেখলে মনে হয় যেন মাটির পুতুল গুলোতে কেউ প্রাণ সঞ্চার করেছে। সুতো দিয়ে বেঁধে তাদের হাত পা নাড়িয়ে নাচ করায় লোকটা। রঙিন পর্দার পেছনে নতুন নতুন গল্প নিয়ে তার রঙ্গমঞ্চ ভরে ওঠে প্রতিদিন, কোনোদিন রাজা – রানির গপ্পো তো কখনো আবার কৃষ্ণের লীলা খেলা। বাচ্চারা তো বটেই সঙ্গে বড়োরাও সেই নাচ হা করে দেখে। আলো ছায়ার এই পুতুল নাচ দেখানোর পাশাপাশি সে পুতুল বিক্রিও করে। তার কাছে কি পুতুল নেই; রাজা, রানি, মন্ত্রী, সেপাই, হাতি, ঘোড়া, যা চাইবে সব আছে। গ্রামের প্রায় সব বাচ্চাই তার থেকে কোনো না কোনো পুতুল কিনে নিয়ে যেতে চায়। 

যে লোকটা খেলা দেখায় তাকে দেখতে অবাঙালি হলেও (যাকে গ্রাম্য ভাষায় বলে হিন্দুস্তানি), তার কথা বার্তায় সে বোঝার উপায় নেই। পরনে একটা নোংরা হয়ে আসা পাঞ্জাবি, আর খাটো করে ধুতি, মাথায় আবার পাগড়ি ও রয়েছে, আর পায়ে এক জোড়া কালো হাওয়াই চটি। জিজ্ঞেস করাতে সে জানায় যে তার নাম বিনোদ এবং তারা আসলে বিহার এর মাতুকপুরের বাসিন্দা কিন্তু বহুকাল আগেই তার বাবা, মা কে নিয়ে দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতা তে চলে আসে নতুন কাজের সন্ধানে। তখন থেকেই এই পুতুল এবং পুতুল নাচের ব্যাবসা শুরু। তাদের এই পুতুলু নাচ দেখিয়েই সংসার চলত। মা মাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে দিত আর সেই পুতুলের ব্যাবসা করেই খেত পরিবারের তিনটি মানুষ। এখন আর বাবা মা নেই তাই সে নিজেই কাজ শিখে ঘুরে ঘুরে ব্যাবসা করে।

দেখলে বেশ বোঝা যায় যে লোকটা বাচ্চা খুব ভালোবাসে, আর সব ক্ষুদে রাও তাকে খুব পছন্দ করে। বিকেল হলেই তার দোকানের সামনে ভিড় জমে সব থেকে বেশি। এমনকি বাকি দোকানে আসা লোকজন ও ওসব ছেড়ে পুতুল নাচ দেখতে চলে আসে। তাই সে মেলার তৃতীয় দিনে মোড়ল মশায়ের কাছে গেলো অনুমতি চাইতে যাতে তাকে সেই গাঁয়ে ব্যাবসা করতে দেওয়া হয়। সব লোকেদের এত উৎসাহ দেখে মোড়ল মশাই তাকে সেখানে কারবার করার অনুমতি দিয়ে দিলেন। এমনকি মোড়ল মশাইয়ের নিজের দশ বছরের মেয়েও সুন্দর একটি রাজা ও রানির পুতুল কিনে নিয়ে গেল। এক মাস ধরে মেলা চলার কথা। 

বিনোদ তাই গ্রামের বুড়ো বট তলার নিচে তাবু খাটিয়ে আস্তানা গাড়ল যার পাশেই কালী মন্দির। তার জিনিস খুবই সামান্য – তার পুতুল রাখার বাক্স, দোকানের তিরপল, উনুন আর একটা ছোটো ডাফল ব্যাগ যাতে তার জামা কাপড়, চাদর, বালিশ, অল্প কিছু বাসন আর কিছু ওষুধের শিশি, এইসব থাকে। সে সকালে উঠে পুকুরে স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে রান্না করে। সে আবার বিশাল কালী ভক্ত, রোজ জবা ফুলের মালা পরিয়ে মা কে পুজো দেয়। তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ হলে হাত মুখ ধুয়ে, বাসন মেজে, মাটি দিয়ে পুতুল বানায়। সেই পুতুল তারপর সুকোলে পরে তাতে রং চাপায়। অকৃতদার মানুষের কাজও থাকে বেশি তাই সে কারো সাতে পাঁচে থাকে না। নিজের কাজ সারতেই তার বেলা গড়িয়ে যায়। কালী মন্দিরে যে কজন পুজো দিতে আসে, তাদের সাথে দু – চারটে কথা বলে কখনও। বিকেল হলে সে তার সরঞ্জাম নিয়ে মেলার মাঠে চলে যায়। রাতে ফিরেও আবার অনেকক্ষণ পুজো করে তারপর শুতে যায়।

এদিকে বাইরের একটি ব্যাবসায়ী এসে তাদেরই গ্রামে তাদেরকেই টেক্কা দিয়ে পশার জমাচ্ছে এটা মেলার অনেক দোকানদারেরই পছন্দ হল না। অথচ স্বয়ং মোড়ল তাকে ঠাই দিয়েছে সুতরাং মোড়লের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা কিছু করতেও পারবে না। তখন দোকানিদের দলের যে পান্ডা, অর্থাৎ কার্তিক বাবু, সে ঠিক করলো কিছু ভাবে যদি এই পুতুল ওয়ালা কে কোনো অপরাধের দায়ে ফাঁসানো যায় তাহলেই একে এখান থেকে তাড়ানো যাবে। আর সেটাও করতে হবে খুব শিগগিরই। সেই কথা মত তারা ঔ রাতেই লোক লাগিয়ে কাজ এগিয়ে রাখল। কার্তিক বাবুর ওই গ্রামেই বিশাল মিষ্টির দোকান। এখন আবার শহরেও একটা শাখা খুলেছেন। মোড়লের খাস লোকজন এলে এনার দোকান থেকেই মিষ্টি কিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সুবাদে, পয়সাকরিও নেহাত কম নেই। তাই সেই টাকার লোভ দেখিয়ে লোক ফিট করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না কার্তিক ময়রাকে।

পরদিন বিকেল নাগাদ পশরা সাজিয়ে যখন বিনোদ বসেছে, হঠাৎ একজন নতুন শহুরে খদ্দের পুতুলের দাম নিয়ে অহেতুক তর্ক শুরু করলেন। তার দাবী যে মাটির পুতুল নাকি এত দামি হওয়া উচিত না। কলকাতা তে নাকি সে প্লাস্টিক এর ভালো বিদেশি পুতুল দেখেছে যা অনেক বেশি টেকসই এবং বিনোদ নাকি লোক ঠকিয়ে টাকা কামাচ্ছে। বিনোদও সেই শুনে অল্প অভিমান দেখিয়ে বললো, “সে আপনি যতই বিদিশী পুতুল কিনুন, তা দিয়ে তো আর এই পুতুল নাচ হয় না ?”। খদ্দেরটি সেই শুনে হাতের পুতুলটা ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। বিনোদ তো সেই দেখে রেগে আগুন। সে লোকটিকে বলে যে তার জিনিস নষ্ট করার জন্য তাকে সেই পুতুলের দাম চোকাতে হবে। এ হেন তর্ক চলতে চলতে ব্যাপারটা হাতাহাতি তে পৌঁছে যায়। আর সেই ঠ্যালাঠেলি তে খোদ্দেরটি যায় পরে। আস পাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে তাকে তুলতে আর ভুল বোঝাবুঝিতে বিনোদ কে বিস্তর কথা শোনানো হয়। এমনকি দুচারটে গালাগালি ও দিতে ছাড়ে না বাকি দোকানদাররা। বিনোদ বাইরে থেকে আসায় তাকে চট করে কেউ বিশ্বাস করে না।

সেই সময় হঠাৎ লোকটা হেই হেই করে চিৎকার করে ওঠে যে তার মানি ব্যাগ টা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সে উঠে হাত পা ঝেড়ে বিনোদ কেই ধরে যে এই দোকানিই তার মানি ব্যাগ চুরি করেছে। বিনোদও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সেও তেড়ে মারতে গেল লোকটাকে। বাকি দোকানদাররা তাকে আটকালো কোনো মতে। খদ্দের লোকটা মানি ব্যাগ নিয়ে এমন হাঙ্গামা শুরু করে যে মোড়ল মশাই কে ডেকে পাঠাতে বাধ্য হয় গ্রামের লোক। মোড়ল মশাই আসায় লোকটা অবাক হয়ে তাকে বলে,”আরে গজানন না?” বাল্য বয়সের বন্ধুকে দেখে গজানন ও হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো কি সমস্যা হয়েছে। বিনোদ কে দেখিয়ে তখন লোকটি চুরির ঘটনা বললো। বিনোদও মোড়ল মশায়ের পায়ে পড়ে তাকে বলে যে সে কোন চুরি করেনি। মোড়ল মশাই সব শুনে রায় দিলেন যে বিনোদ এর জিনিসপত্র খুঁজে দেখলেই তো বোঝা যাবে যে সে সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে। মোড়লের এক লোক তখন এগিয়ে এসে বিনোদ এর জিনিসপত্র খুঁজে দেখতে থাকে আর পুতুলের বাক্সের ভীতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা কালো মানি ব্যাগ। খদ্দের টা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে যে এটাই নাকি তার ব্যাগ। এসব দেখে বিনোদও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। সে তো জানে যে সে চুরি করেনি কিন্তু এ ব্যাগটা তাহলে বাক্সে গেলো কেমন করে। এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার পিঠে একটা জোর ধাক্কা লাগে আর তাতেই তার সম্বিত ফিরে আসে। গ্রামের লোকজন বেজায় ক্ষেপে গেছে ওর ওপর। একেবারে এই মারে কি সেই মারে। তার কোনো কথাই শুনতে তারা নারাজ।

যারা এতদিন ওর পুতুল নাচ দেখতো আজ তারাই ওকে পিটিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি শোনাচ্ছে। মোড়ল মশাইও নিজের বন্ধু কেই বিশ্বাস করে বিনোদকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার আদেশ দিলেন। বাকি দোকানদাররা তাকে গ্রামের শেষ অব্দি মারতে মারতে নিয়ে গেলো। তারা গ্রামের সীমানায় পৌঁছে, বিনোদকে ঘিরে দাড়িয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো। বিনোদ এর তখন ব্যাথায় গা হাত পা জ্বলে যাচ্ছে। সারা গা ক্ষত বিক্ষত অবস্থা। মুখ ফুলে, ঠোঁট ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। 

তখন কার্তিক বাবু বিনোদ এর সামনে বসে নিচু স্বরে তাকে বলল,” খুব ব্যাবসা করার শখ না রে তোর? এবার কিভাবে তুই ব্যাবসা করিস আমিও দেখব”। 

পাশ থেকে একজন বলে ওঠে, “তবে দাদা, মোড়লের ওই বন্ধুকে হাত করে বেশ লাভই হলো বলো? আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ বের করেছ। মর এবার তুই এখানে”। 

“তা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে দেখ? ওকে যে গ্রামছাড়া করতে গেলে এটা করতেই হতো। সময় মত ভাগ্যিস মানি ব্যাগটা বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম”। 

বিনোদ রাগে কষ্টে গর্জাতে গর্জাতে বলল, “এটা তুই ঠিক করলি না কার্তিক। কালীর ভক্তকে এভাবে মিথ্যে অপবাদ দিলি, এর ফল ভালো হবে না”।

এই শুনে তারা আবার হেসে, বিনোদ কে কয়কটা লাথি মেরে ওখান থেকে চলে গেল। বিনোদ ওখানেই অজ্ঞান হয়ে গেল।

পরদিন সকালে দেখা গেল বুড়ো বট তলায় বিনোদ এর তাবু টা যেখানে থাকত সে জায়গায় অনেকটা ছাই আর পাঁচ – ছটা জবা ফুল পরে রয়েছে। আর তার জিনিসপত্রও আসে পাশে কোথাও দেখা গেল না। সকলেই ভাবলো রাতে এসে হয়তো বিনোদ নিজেই জিনিসপত্র নিয়ে এখান থেকে বিদায় হয়েছে। যাক সে গেছে বাঁচা গেছে। এমনিও গ্রামে অমন চোর ঘুরে বেড়ালে খুব সমস্যা। তাই কেউ আর এই বিষয় টা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না। মেলার মাসটা ভাল ভাবেই কেটে গেল সবার। বাচ্চাদের একটু মন খারাপ হলেও, তারাও এক সময় ভুলে গেল। কার্তিক ময়রাও সেই মেলায় প্রচুর লাভ করে মেয়ে কে দারুণ দারুন সব খেলনা, বউ কে শাড়ি-গয়না এসব কিনে দিল। বাড়ির লোকজন খুব খুশি।

এদিকে মোড়লের বন্ধুকেও ভালো পরিমাণ টাকা দিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করেছেন গ্রাম থেকে। সে বেশিদিন গ্রামে থাকলে যদি ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায়, তখন কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

সেই ঘটনার বেশ কিছু মাস পরে, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যে বেলা, কার্তিক বাবুর সদর দরজায় টোকা পরে।  তার ষোলো বছরের মেয়ে, রমা এসে দরজা খুলে দেয়। ভারি মিষ্টি মেয়ে। সবুজ রঙের চুরিদার পরে সে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,”আরে বিনোদ চাচা? তুমি কবে ফিরলে? আর এরকম সাধুর পোশাক পড়েছ কেন?”

 বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকেই। হাওয়ার দাপটে জানলা দরজা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এরই মধ্যে লোডশেডিং হয়ে গেল। কার্তিক বাবুর স্ত্রী মোমবাতি খুঁজতে ঘর থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে দেখল সদর দরজাটা হাট করে খোলা আর বৃষ্টির জল ঢুকে উঠোন পুরো ভিজে একসা। 

“এই কে কোথায় আছিস? একটু দেখছিস না, ঘরে তো জল ঢুকে যাচ্ছে রে” , বলতে বলতে উনি সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে উঠোনে কি একটা দেখে ভীষণ অবাক হলেন। এগিয়ে গিয়ে দেখেন মাটিতে উপুড় করে পরে আছে একটা পুতুল। হাতে তুলেই চিৎকার করে আবার ছুড়ে ফেলে দেন ওটা। সবুজ চুরিদার পড়া রমার মতোই দেখতে পুতুল টার গায়ে যে লেখা ‘প্রতিশোধ’। 


By Sanchita Kar



18 views0 comments

Recent Posts

See All

দিনলিপি

By Tanushree Ghosh Adhikary 'দিব্যি আছি', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো।  তুমিও তোমার মতো দিব্যি আছো। মনে পড়ার গল্পে আজ আর যাব না। ভুলত...

Waiting For Someone?

By Kasturi Bhattacharya ‘I keep insisting you on doing things that you do not like, I get it, but we don’t have any other options.’ ‘I...

The Hostel Menace

By Jameel Shahid Raza Hello people, I am Jameel, 18 years old, I am currently pursuing engineering. I live in hostel which is free for...

Comments


bottom of page